আপনি কি জানেন, কিভাবে এক আদিবাসী ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছিলেন? থ্রিলার মুভি কেও হার মানাবে এটি
এই গল্পটি ইতিহাসের এক বিস্ময়কর উপাখ্যান, যেখানে ষোড়শ শতাব্দীর দক্ষিণ আমেরিকার গভীর জঙ্গলে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল। বলা হয়, সেই সময়ের পেরুর এক গভীর জঙ্গলে এক ‘ইন্ডিয়ান’ আদিবাসী পথ হারিয়ে যায়। এই ‘ইন্ডিয়ান’ বা আদিবাসী মানে কিন্তু আমরা যেমন সাধারণত ভারতীয়দের বুঝি, তেমন নয়। আমেরিকা মহাদেশে স্থানীয় আদিবাসীদের ‘ইন্ডিয়ান’ নামে অভিহিত করা হয়। এরা সাধারণত জঙ্গলের গভীরে জীবন যাপন করত এবং জঙ্গলই ছিল তাদের প্রধান আশ্রয় ও খাদ্যের উৎস। কেন সে পথ হারিয়েছিল, তা নিয়ে বিভিন্ন কাহিনি রয়েছে—হয়তো দলছুট হয়ে বা দিগভ্রান্ত হয়ে দূর কোন অজানা অঞ্চলে চলে গিয়েছিল সে। আদিবাসীরা এমনিতেই অভ্যস্ত ছিল প্রকৃতির সাথে জীবনযাপন করতে, তাই একা একা জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া তার জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতো ছিল।
জঙ্গলে খাবারের অভাব না থাকলেও, একা একা থাকার যন্ত্রণা ছিল প্রচণ্ড। আদিবাসী লোকটি প্রথমে জঙ্গলের বিভিন্ন ফলমূল খেয়ে দিন পার করছিল। জঙ্গলের ফলমূল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদই তার জীবনধারণের একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কিছুদিন পর লোকটি মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। তার জ্বর আসতে শুরু করে এবং শরীর একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে, যেন মৃত্যুর কাছাকাছি চলে আসে সে। একাকী, অসুস্থ, এবং দুর্বল অবস্থায় সে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, কারণ তখন আর কোনো আশা বাকি ছিল না।
অসুস্থ হওয়ার পাশাপাশি তার শরীরে প্রচণ্ড পিপাসা অনুভব হতে থাকে। পিপাসার যন্ত্রণা সহ্য করা তার জন্য আরও কষ্টকর হয়ে ওঠে, কিন্তু আশেপাশে পানির কোনো উৎস দেখতে পাচ্ছিল না সে। অসুস্থ শরীর নিয়েই সে পানির সন্ধান শুরু করে, যা ছিল অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। তবে সে হাল ছাড়েনি। অবশেষে, এক জংলি জলাশয়ের খোঁজ পেয়ে যায়। পিপাসায় কাতর হয়ে সে জলাশয়ের পানির দিকে ছুটে যায়, কিন্তু যখন পানি মুখে দেয়, তখন বুঝতে পারে পানিটি একেবারে তেতো এবং বিস্বাদ। পানিটা আসলে খাওয়ার উপযোগী ছিল না, কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয় সে। তেতো সেই পানিই সে পান করতে শুরু করে, কারণ অন্য কোনো উপায় তার কাছে ছিল না।
তেতো পানি পান করার পরও জ্বর কমছিল না, আর এমনিতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে কয়েকদিন পার করে দেয় জলাশয়ের আশেপাশেই। তেতো পানির স্বাদ সত্ত্বেও সে পানি খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টায় ছিল, যদিও তার শরীরের অবস্থা ভালো ছিল না। তবে কয়েকদিন পরে সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে, ধীরে ধীরে তার শরীরের জ্বর কমে যাচ্ছে। ম্যালেরিয়া থেকে আস্তে আস্তে মুক্তি পাচ্ছে সে। তখনও সে অবাক, কারণ তার মনে হচ্ছিল এমন তেতো পানি পান করে কিভাবে সুস্থ হয়ে উঠল সে। এ নিয়ে ভাবতে থাকে সে, কীভাবে এমন অলৌকিকভাবে তার জ্বর সেরে উঠল।
এখানেই তার কৌতূহল আরও বাড়তে থাকে এবং সে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারে যে জলাশয়ের পানির তেতো স্বাদ আসলে সেখানকার কিছু গাছপালা থেকেই এসেছে। বিশেষত, সিনকানা নামে একটি গাছের পাতা ও গাছের টুকরোগুলো জলাশয়ের পানিতে ভাসমান ছিল এবং পানির সাথে মিশে তার তেতো স্বাদ তৈরি করেছিল। সিনকানা গাছটি ছিল পুকুরের চারপাশে পূর্ণ। গাছের পাতার তেতো স্বাদ পানির সাথে মিলিয়ে পানিকে তিক্ত করেছে, যা তাকে ম্যালেরিয়া থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করেছে।
পরে, সে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারে যে, সিনকানা গাছের পাতার নির্যাসই তাকে সুস্থ করে তুলেছে। সে সিনকানা গাছের পাতা হাতে নিয়ে স্বাদ গ্রহণ করে এবং নিশ্চিত হয় যে এই গাছই তাকে রোগমুক্ত করেছে। সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর সে তার সম্প্রদায়ের সবাইকে এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার কথা জানায় এবং তার আবিষ্কার করা এই তেতো পানির ওষুধের কথা বলে। সিনকানা গাছের পাতা যে এমন তেতো স্বাদের হতে পারে, তা এর আগে কেউ বুঝতে পারেনি, এবং তার এই অভিজ্ঞতা সবাইকে আশ্চর্য করে।
এই গল্পটির সত্যতা নিয়ে অবশ্য অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তবে এটি নিশ্চিত যে এই সিনকানা গাছ থেকেই ম্যালেরিয়ার প্রথম ওষুধ কুইনাইন আবিষ্কার করা হয়েছিল। সিনকানা গাছের নির্যাস ম্যালেরিয়া থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করতে পারে, এ ধারণা থেকেই পরে কুইনাইন নামক ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক তৈরি হয়। কুইনাইন পরবর্তীতে ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় প্রধান ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং বিশ্বব্যাপী অনেক রোগীর জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে। এই গল্পটি একভাবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে কারণ সিনকানা গাছ থেকে কুইনাইনের আবিষ্কার আজও চিকিৎসা জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
0 Comments